দুঃখের ব্যাপার হলো, নদী ও পানি নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা এখনো ব্রিটিশ আমলেই ঠেকে আছে। তাই নদী তীরবর্তী মানুষ হলো অবহেলিত, ইটভাটার মালিক হলেন প্রতিষ্ঠিত।
মার্চের ১৪ তারিখ আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হলো নদীর জন্য করণীয় দিবস হিসাবে। নদীর গুরুত্ব তুলে ধরে সচেতনতা তৈরিই এ দিনের উদ্দেশ্য। দিনটিতে নদীপ্রেমীরা দুঃখের সঙ্গে মনে করেন প্রতিদিন পৃথিবীর নদীগুলো প্রায় দুই মিলিয়ন টন পৌর, শিল্প ও কৃষিবর্জ্যের ভাগাড় হয়।
ঢাকার গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) দেশের দূষিত বা রুগ্ন নদ-নদীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। দেশের নদীগুলোর স্বাস্থ্য ও জলজ চরিত্র বিশ্লেষণ করে ৫৬টি নদীতে তারা অতিমাত্রায় দূষণ খুঁজে পেয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আরো অধিক বর্ণনার আগে আরডিআরসির কথা বলে নেওয়া যাক। মোহাম্মদ এজাজ প্রতিষ্ঠানটির প্রজেক্ট লিড। অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা শেষ করে দেশে আসেন ২০০৪ সালে। দেশে এসে শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। প্রায় ১০ বছর অধ্যাপনা শেষে ভাবলেন এবার দেশের জন্য কিছু করবেন। তিনি জানেন, এ দেশের ৬৭ ভাগ এলাকা বর্ষাকালে পানির দখলে থাকে। ভাটি বাংলার চলন, বলন, খাওন-পরন সবই পানিনির্ভর। এ দেশে কেবল নদীর সংখ্যাই হাজার ছুঁই ছুঁই। তাছাড়া আছে খাল-বিল-হাওড়-বাওড়-পুকুর-দীঘি। তাই এজাজ স্থির করলেন কাজ করবেন নদী নিয়েই। প্রতিষ্ঠা করলেন আরডিআরসি। শিক্ষক, সাংবাদিক এবং শিক্ষার্থী কিছু বন্ধু আর শুভানুধ্যায়ীকে পেলেন পাশে। পরামর্শ পেয়েছেন উবিনীগের ফরিদা আকতার ও ফরহাদ মজহারের কাছ থেকে। তারা খেয়াল করেছেন, নদীর সঙ্গে বাংলার সম্পর্কের বাঁক বদল ঘটে ব্রিটিশরা বাংলা দখলের পর থেকে। কারণ বন, পাহাড়ের মতো নদীকেও তারা সম্পদের উৎস ভাবল আর পরিণত করল কেনা-বেচার বস্তুতে। আরো দুঃখের ব্যাপার হলো, নদী ও পানি নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা এখনো ব্রিটিশ আমলেই ঠেকে আছে। তাই নদী তীরবর্তী মানুষ হলো অবহেলিত, ইটভাটার মালিক হলেন প্রতিষ্ঠিত।
উন্নয়ন শুরু হয় ধ্বংস দিয়ে
আমাদের দেশে বংশ পরম্পরায় জেলেরা নদীর ধারে থাকে, নদী থেকে পানি নিয়ে এসে কৃষক ফসল ফলায়, নদীধারের তৃণভূমিতে রাখাল গরু চড়ায়, নদীতে ভেসে ভেসে বেপারি আসে নতুন নতুন পসরা নিয়ে, হাতে কাজ না থাকলে মানুষ সুখ-দুঃখের কথাও কয় এই নদীর সঙ্গেই । কিন্তু উন্নয়ন যত ঘনিয়ে এলো ততই নদীর কষ্ট বাড়তে থাকল। নদীর তীর ঘেঁষে বসল সুতার, কাপড়ের, পাটের মিল আর ইটের ভাটা। নদী-খাল-বিলের ওপর ব্রিজ, কালভার্ট চেপে বসল। উন্নয়নের আবর্জনা ফেলার জায়গাও হলো নদী। দিনে দিনে নগরের শরীর ফুলে উঠতে থাকলে নদী দখল আর ভরাটের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেল। নদীর দুঃখ আরো বাড়ল। অনেক নদী শীর্ণ হয়ে খালে পরিণত হলো, কিছু নদী হারিয়ে গেল চিরতরে।
এজাজ বলছিলেন, ‘পানি নেমে যাওয়ার পর আমাদের নদী তীর হয়ে ওঠে শস্যক্ষেত্র, খুব বেশি দেশ কিন্তু প্রকৃতির এ আশীর্বাদে পুষ্ট নয়। প্রকৃতি থেকে আমরা অনেক কিছুই মিনিমাগনা পাই, যে কারণে তার মূল্য বুঝি না। যেমন কোভিড না হলে আমাদের অনেকের বুঝতে বাকি থেকে যেত অক্সিজেন কত প্রয়োজনীয় আর দামি। পানির ব্যাপারেও তেমনটাই ঘটেছে। পানি ঘিরেই আমাদের চলাচল অথচ বুঝতে পারি না পানির দাম।’
সেকারণেই আরডিআরসি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নদীগুলোকে জানতে চাইছে। বেশি কাজ করছে ঢাকা ও তার আশপাশের নদীগুলো নিয়ে। কয়টি ড্রেন আছে নদীগুলোয়, কতটি ডাস্টবিন আছে, চ্যানেল কয়টি, কোন কোন পয়েন্টে পলিউশন বেশি, নদীপাড়ের মানুষ কারা, নদীর পানিতে কী কী উপকরণ আছে ইত্যাদি সবকিছু তারা হিসাবে আনছেন। ইতিমধ্যে চারটি জেলার (গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ আর নারায়ণগঞ্জ) কাজ অনেকটাই এগিয়ে এনেছেন।
এজাজ বলছিলেন, ‘সুনির্দিষ্ট তথ্য হাতে থাকলে সংশ্লিষ্ট সকলেরই সুবিধা। আমরা বুড়িগঙ্গায় ২৫০টির বেশি ড্রেন খুঁজে পেয়েছি অথচ বিআইডব্লিউটিএর হিসাব থেকে মাত্র ৬০টির কথা জানা যাচ্ছিল। এখন কিন্তু নদীটার স্বাস্থ্য সংরক্ষণ আগের চেয়ে সহজ হবে।’
তিন মাসে একটি করে প্রতিবেদন
ঢাকা ওয়াটার ওয়াচ নামের একটি পর্যবেক্ষক দলও গঠন করছে আরডিআরসি। প্রতি তিনমাসে ঢাকার জলাশয়গুলোর অবস্থা নিয়ে একটি করে প্রতিবেদন তৈরি করবে তারা। এজাজ বলেন, ‘২০৫০ সালের মধ্যে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মেগাসিটিতে পরিণত হবে। এখানে গ্রাম থেকে নিয়মিতই লোকেরা জীবন ও জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছে। জলবায়ু পরির্তন গ্রাম থেকে শহরে এ অভিবাসনকে ত্বরান্বিত করছে। এক সময় তুরাগ হয়ে উঠবে ঢাকার মাঝখানের নদী। নতুন করে ভিড় করা মানুষেরা ঢাকার পরিবেশের ওপর আরো চাপ তৈরি করবে। তাই ঢাকার ওপর নজর রাখা ও সে প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।’
এজাজ বলছিলেন, ‘উন্নয়ন তো কেবল ভূগোল বদলায় না, মানুষকেও অস্থির করে তোলে। আর তাই আমাদের গবষেণা হবে বহুমুখী।’
রেনেলের মানচিত্রের সঙ্গে
আরডিআরসি বাংলাদেশের এখনকার নদ-নদীগুলোর পূর্ণাঙ্গ একটি মানচিত্র তৈরি করতে চাইছে যেটি মিলিয়ে নিতে চাইছে ২৪০ বছর আগে করা জেমস রেনেলের (১৭৪২-১৮৩০) মানচিত্রের সঙ্গে। ১৭৬৪ সালে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর হেনরি ভ্যান্সিটার্ট। তিনি গঙ্গা (পদ্মা) থেকে সমুদ্র পর্যন্ত জাহাজ চলাচলের উপযোগী একটি নৌপথ আবিষ্কারের দায়িত্ব দিলেন জেমস রেনেলকে। বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে যেন ব্রিটিশদের বাণিজ্য চালাতে অসুবিধা না হয় সেটাই ছিল লক্ষ্য। কাজটি যেন দ্রুত শেষ হয় সেই তাগিদও দেওয়া হয়েছিল রেনেলকে। এর মধ্যে বাংলার দেওয়ানী লাভ করায় ব্রিটিশ বণিক রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। ক্লাইভ রেনেলকে সমগ্র বাংলার একটি মানচিত্র তৈরির নির্দেশ দেন। ‘৬৫ সালের অক্টোবরে রেনেল বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জরিপ শেষ করে মানচিত্র তৈরির কাজে বসে যান।
১৭৭৯ সালে প্রকাশিত হয় তার অ্যাটলাস অব বেঙ্গল, সঙ্গে একটি স্মৃতিকথা। এতে বাংলার গুরুত্বপূর্ণ স্থান, সড়কপথ, নদী ও নদীপথের বিবরণ মেলে। কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত চারটি নৌরুটের বিবরণ তিনি দিয়েছেন। বর্ষায় গঙ্গা ব্যবহার না করে বিল-ঝিলের মধ্য দিয়ে একটি শর্টকাট রুটের কথাও বলেছেন। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার তিনি পাঁচটি রুটের কথা বলেছেন। সিলেট আর রংপুর যাওয়ারও আলাদা রুটের কথা বলেছেন। বর্ষা ও শুকনা মৌসুমের জন্যও তিনি আলাদা আলাদা নৌ রুট উল্লেখ করেছেন। রেনেল থেকে আজ অবধি ২৪০ বছরে মনুষ্যসৃষ্ট কারণেও নৌপথের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, বর্তমান সময়ের সঙ্গে যা মিলিয়ে দেখলে আমাদের সতর্ক ও সচেতন হওয়া সহজ হবে।
দূষিত ৫৬ নদী
আরডিআরসির তালিকায় যে ৫৬টি নদীর নাম এসেছে তার কয়েকটি তো লোকের মুখে মুখেও ফেরে। পানির রং দেখেও আন্দাজ হয় খানিক। বুড়িগঙ্গার মাছ বললে কেনার জন্য হামলে পড়বে কতজন তা বিক্রেতাদের ভালোই জানা! শিল্প আর পৌর বর্জ্য এবং প্লাস্টিক দূষণই মূলত নদীগুলোর দুর্দশার কারণ। এ নদীগুলোর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বংশী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলি, খুলনার পশুর, সিলেটের খোয়াই, কক্সবাজারের বাঁকখালি, যশোরের ভৈরব, কক্সবাজারের মাতামুহরী, হবিগঞ্জের জাদুকাটা, বরিশালের জাদুকাটা ইত্যাদি।
নদীগুলোর অসুখের কারণ যেমন মানুষ, আবার মানুষই পারে এগুলোর অসুখ সারাতে। নইলে ক্ষতি হবে মানুষেরই। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় কত গঞ্জই (বাজার) না মরে গেছে! দূষিত নদীর পানিতে নাওয়া যেমন চলে না, তার হাওয়াও স্বাস্থ্য নষ্ট করে। তাই আরডিআরসি চাইছে, আগামীতে ১৪ মার্চ যেন কেবল হতাশাতেই পার না হয়।
মূল উৎসঃ ৫৬ অসুখী নদীর জন্য কান্না | The Business Standard (tbsnews.net)