অববাহিকা তিস্তা একটি নদীর নাম, সম্পাদক-মোহাম্মদ এজাজ, প্রকাশক-আরডিআরসি, পরিবেশক-জাগতিক প্রকাশনী, মূল্য-৪০০ টাকা
সঞ্জয় ঘোষ
প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২২ | ১২:০০
নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্যই শুধু নয়, নদী পৃথিবীর বা পরমাপ্রকৃতির আত্মস্বরূপ। মানুষের ক্রমবর্ধমানতার চাপে সেই আত্মা ক্রমশই বিনাশের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। নদীকে বাঁচাতে তাই দেশে দেশে উদ্যোগ-আন্দোলনের কমতি নেই। বাংলাদেশের নদী আন্দোলনেরও রয়েছে নিজস্ব বাস্তবতা। বলছি ‘অববাহিকা’ নামক একটি নদীবিষয়ক জার্নালের কথা। বাংলাদেশের রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের [আরডিআরসি] সভাপতি মোহাম্মদ এজাজ সম্পাদিত নদীবিষয়ক জার্নাল ‘অববাহিকা’ মূলত বাংলাদেশের নদীগুলোর বেসিনভিত্তিক বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে তুলে আনার একটা প্রচেষ্টা। যার প্রতি সংখ্যায় কোনো একটি নদী নিয়ে সবিস্তারে আয়োজন প্রকাশিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ‘অববাহিকা’য় এবার উঠে এসেছে ‘তিস্তা’ নদী। আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর মধ্যে যেমন, তেমনি বাংলাদেশের সমস্ত নদীর মধ্যে তিস্তা অন্যতম। আমাদের চতুর্থ বৃহত্তম নদী এই তিস্তা। সেই তিস্তার ওপর দেওয়া বাঁধ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ দু’দেশের মধ্যে চলছে বহু দিনের উত্তপ্ততা। সেই উত্তাপ ও অন্যান্য বাস্তবতার আদ্যোপান্ত নিয়ে অববাহিকার এবারের সংখ্যা ‘তিস্তা একটি নদীর নাম’। জার্নালটির ‘তিস্তা’ আয়োজনের শুরুতেই স্থান পেয়েছে সম্পাদক মোহাম্মদ এজাজের গবেষণালব্ধ একটি বৃহৎ পর্যালোচনা। ‘তিস্তা অববাহিকার ভূরাজনৈতিক বিশ্নেষণ’ শিরোনামের এ রচনাতে তিস্তা নদীর নামকরণ ও ইতিহাসের সূচনা পর্যায় থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে লেখক তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ এবং ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার তিনটি ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট। তিস্তা নদীর ড্যাম ও ব্যারেজগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তিস্তা অববাহিকার জনসংখ্যার খতিয়ান এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিশ্নেষণ করতে গিয়ে নানাবিধ ক্ষতি, ঘাটতি ও সম্ভাবনার জায়গাগুলোর কথা বলেছেন। তিস্তা নদীবিধৌত দুই দেশের অঞ্চলগুলোর কৃষি, শিল্প ও জলবায়ুগত নানা দিক এতে উঠে এসেছে। স্থান পেয়েছে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক বিরোধের বিভিন্ন সমীকরণ। তিস্তা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সংকটের পাশাপাশি যেখানে উঠে এসেছে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিরোধগুলোও। এর পরই লেখক তিস্তা চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ নানাদিক বিস্তারিতভাবে উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। তিস্তা বিরোধের ইতিহাস থেকে শুরু করে তা সমাধানে আলোচনার ব্যর্থতা ও সরকারগুলোর অবস্থান এবং তাতে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার উপস্থিতি এমন নানা বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে এ রচনায়। জার্নালে একে একে স্থান পাওয়া প্রতিটি রচনাই তিস্তা নদী ও তাকে ঘিরে এ অঞ্চলের সংকটকে মূর্ত করতে দারুণভাবে সক্ষম। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজের ‘…অথচ তিস্তা চুক্তি হলো না’ শীর্ষক রচনাটিতে তিস্তা চুক্তির রাজনৈতিক বাস্তবতা ও এর পেছনের অনেক অন্ধকার প্রকোষ্ঠকে প্রকাশ করার প্রচেষ্টা। তিস্তা নিয়ে দুই দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সদিচ্ছাহীনতার কথা যেমন তিনি বলেছেন, তেমনি তুলে ধরেছেন পানি না দেওয়ার নানা কৌশল। সেই সঙ্গে পানি নিয়ে ভারতীয় কূটনীতির ঐতিহাসিক বিবর্তন নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন আলতাফ পারভেজ। শফিয়ার রহমানের ‘তিস্তাবাসী ও তিস্তা আন্দোলন’ শিরোনামের লেখাটির মাধ্যমে পাঠক একেবারে তিস্তাপাড়ের জনজীবনের দুর্ভোগ ও আবেগের অনুপুঙ্খ বিবরণ পাবেন। লেখক যেমন লিখেছেন- ‘তিস্তাপাড়ের সংস্কৃতি নদীভাঙন ও বন্যার করাল গ্রাসে হারিয়ে গেছে। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের গান ভাওয়াইয়া আর আগের মতো নেই। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা প্রায় হারিয়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে ছিল ঝুমুর যাত্রা দল, জারিগান, কুশাইন গান আর ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের কীর্তন প্রতিযোগিতা। ছিল নৌকাবাইচ।’ এসব হারিয়ে গেছে সত্যি- তবে শফিয়ার রহমানের বর্ণিত এই সংস্কৃতি চর্চার উপাদানগুলোর হারিয়ে যাওয়া শুধু তিস্তাপাড়েই নয়, বাংলাদেশজুড়েই হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের তিস্তা প্রবাহিত জেলাগুলোর মধ্য থেকে লেখকের লালমনিরহাট জেলার চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে সমগ্র তিস্তাপাড়ের মানুষের দুর্ভোগ তুলে ধরার প্রচেষ্টাটি পাঠককে এ প্রসঙ্গে ঋদ্ধ করবে বৈকি।
নদী অধিকার মঞ্চ কর্মী শমশের আলীর ‘তিস্তা নদীর প্রবাহ ও জলা-জমির ব্যবস্থাপনা’, কলকাতার সাংবাদিক অমর সাহার ‘তিস্তা’, নদী গবেষক ও সমাজকর্মী সৌমিত্র ঘোষের ‘উন্নয়ন ও তিস্তাপাড়ের নয়া বৃত্তান্ত’, ভারতের সুপ্রতিম কর্মকারের ‘তিস্তার জল কোথায় গেল?’, নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন মহাপরিচালক মোহাম্মদ সাজিদুর রহমান সরদারের ‘তিস্তার অববাহিকা পর্যালোচনা ও উন্নয়ন ভাবনা’- এ সবই তিস্তা নিয়ে এ অঞ্চলের বহু বছরের সমস্যার নানা দিক নিয়ে বিশেষ রচনা। যা পাঠককে সমৃদ্ধ করবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিলের সাক্ষাৎকার রয়েছে এ জার্নালে। সম্পাদক মোহাম্মদ এজাজের গৃহীত এ সাক্ষাৎকারে যথারীতি তিস্তা নিয়ে রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা-সংক্রান্ত নানবিধ কথা উঠে এসেছে। তিস্তা নদী তো কেবল রাজনৈতিক বিরোধেরই বিষয় নয়, এ নদী বাংলা ভাষার সাহিত্যেরও এক অনন্য আকর। তিস্তা আলোচনা তাই সেই সাহিত্যিক সংযোজন ছাড়া অনেকাংশে অসম্পূর্ণ থেকে যেত। এ কথাটাই সম্পাদক প্রমাণ করেছেন জার্নালের এই তিস্তা সংখ্যায় তিস্তার সাহিত্যিক অধ্যায়টিকে যুক্ত করে। এ পর্যায়ে তাতে স্থান পেয়েছে গৌতম রায়ের ‘তিস্তার কথা’, ড. বাকি বিল্লাহ বিকুলের ‘নদীকথা ও তিস্তা নদী’, জাকারিয়া মণ্ডলের ‘ফিরিয়ে দাও তিস্তা’, হারুন পাশার ‘তিস্তা এবং নদী-মানুষের ক্ষরণ’ শীর্ষক লেখাগুলো। যাতে তিস্তা নদীকেন্দ্রিক সাহিত্যপ্রচেষ্টার পৌরাণিক পর্যায় থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত উঠে এসেছে নানাভাবে।
সবশেষ একটি তথ্যচিত্র, সৈয়দ কামরুল হাসান রচিত অজয় রায়ের ‘তিস্তার গল্প’ কেবল একটি নদীর গল্প নয়- এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ‘তিস্তার পাড়ের দিনগুলো’, সংবাদপত্র থেকে তিস্তা নিয়ে প্রকাশনা, ডকুমেন্টেশন ও আলোকচিত্র সব মিলিয়ে ‘অববাহিকা’ নদীবিষয়ক জার্নালের এই তিস্তা সংখ্যাটিকে তিস্তা নিয়ে এ যাবৎকালের একটি সেরা প্রকাশনার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম।