দেশে নদ-নদীর সংখ্যা কত এ নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। দখল-দূষণে কত নদী হারিয়ে গেছে সেই সংখ্যাও সুনির্দিষ্টভাবে কারও জানা নেই। দেশের নদ-নদী নিয়ে যখন এমন অবস্থা তার মধ্যে নদীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। কমিশনের তথ্য বলছে, দেশের নদ-নদীর সংখ্যা ৯০৭টি। শেষ পর্যন্ত তাদের এ তালিকা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।
২০১৯ সাল থেকে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন নদ-নদীর তালিকা তৈরির কাজ হাতে নেয়। এরপর প্রতিটি জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেয় নিজ নিজ জেলার নদীর তালিকা তৈরি করতে। জেলা প্রশাসকরা নিজ নিজ জেলার বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় তথ্যগুলো সংগ্রহ করে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনে পাঠান। ৬৪ জেলা থেকে আসা নদীর তথ্য এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং নদী নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর সঙ্গে নদীবিষয়ক তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। এরপর এই খসড়া তালিকা তৈরি হয়।
নদী গবেষকরা বলছেন, দেশে নদ-নদী রয়েছে ১ হাজার ৬০০-এর বেশি। কিন্তু এনআরসিসির তালিকায় তা নেমে এসেছে ৯০৭টি। আবার সরকারি অন্যান্য তালিকার সঙ্গেও এটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এনআরসিসির খসড়া তালিকার বাইরেও দেশে আরও অন্তত ৬০০ নদী রয়েছে। নদী কমিশন তাদের পর্যালোচনায় জানিয়েছে, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নদী চিহ্নিত করতে হবে সিএস মেনে। অথচ কোন জরিপ রেকর্ডের ভিত্তিতে নদী কমিশন খসড়া তালিকা তৈরি করেছে, তা উল্লেখ নেই।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নদী কমিশন যে তালিকা প্রকাশ করেছে সেখানে কিছু কিছু বড় নদীকেও খাল বলা হয়েছে। আবার খালগুলোকেও নদী বলা হয়েছে। দেশে কয়টা নদী আছে তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহের যে চ্যানেলগুলো আছে সেটা ঠিক আছে কি না সেটা। আমি এখন নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে শত বছর ধরে মানুষের নদীর নামের যে ধারণা আছে সেটাকে ভায়োলেট করা হবে। আসলে নতুন করে নদীকে সংজ্ঞায়িত করার কিছু নেই। বরং নদীরক্ষা করা বড় বিষয়।
এদিকে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন প্রকাশিত নদীর সংখ্যার বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করেছে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। তাতে দেখা গেছে নদীর দৈর্ঘ-প্রস্থ নিয়ে বেশ অসামঞ্জস্য রয়েছে। এছাড়া নদীর উৎপত্তিস্থল নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। আবার কোথাও কোথাও একই স্থান বা উপজেলার নামে একাধিকবার লেখা হয়েছে।
নদীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের মিল নেই : নদী কমিশন যে তালিকা প্রকাশ করেছে সেখানে নদীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নিয়ে আপত্তি রয়েছে নদী গবেষকদের। প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী ৬২টি নদী রয়েছে যেগুলোর দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটার বা তার চেয়ে কম। এছাড়া তিন কিলোমিটার বা তার কম দৈর্ঘ্যরে নদী রয়েছে ২০৭টি। স্বল্প দৈর্ঘ্যরে কারণে এগুলোতে তেমন কোনো গতিবেগ বা যথেষ্ট প্রবাহ সৃষ্টি হয় না। উৎস বা ক্যাচমেন্ট এরিয়া থেকে উল্লেখযোগ্য প্রবাহ সৃষ্টি না হলে কোনো জলধারাকে নদী বলা চলে না।
সম্প্রতি জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন থেকে ‘নদ-নদী’ এর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তার আলোকেও এগুলোকে নদী বলা যায় না। এই বিবেচনায় প্রকাশিত তালিকা থেকে বাদ পড়ে ৩০০ নদী। সেক্ষেত্রে কমিশনের তালিকা অনুযায়ী ৬০০ নদী থাকবে।
আরডিআরসির তথ্য মতে, কমিশনের খসড়া নদ-নদীর তালিকায় ১০৭টি নদীর মধ্যে কোনো নদীরই প্রস্থ, গভীরতা বা পানি সমতলের তথ্য দেওয়া হয়নি এবং কমবেশি ৬৩৩টি নদীর উৎসমুখ ও ৬৩২টি নদীর পতনমুখের তথ্য উল্লেখ নেই। অন্তত ১৬টি নদীর দৈর্ঘ্যরে ঘর ফাঁকা রয়েছে এবং অন্তত ৩৩টি নদীর দৈর্ঘ্যরে স্থানে আয়তন বা একর লেখা রয়েছে। ফলে নদীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ অনুমান করা যাচ্ছে না।
তালিকায় অনেক স্থান বা উপজেলার নাম ভুল রয়েছে, একই স্থান বা উপজেলার নামে একাধিক বানান লেখা হয়েছে। প্রায় ৬০টি নদীর উৎসমুখ ও পতনমুখ উল্লেখ নেই। আবার জেলা ও উপজেলার নাম ভুল রয়েছে। কোথাও কোথাও জেলা উপজেলার নাম উল্লেখ করাই হয়নি। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় মাকুন্দা নদী ৮৫ কিলোমিটার দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বিশ্বনাথে এ নদীর দৈর্ঘ্য আরও কম।
নদীর উৎসমুখ নিয়ে বিতর্ক
নদী কমিশনের তালিকায় প্রকাশ করা নদীর উৎসমুখ নিয়েও অসামঞ্জস্য রয়েছে। মহানন্দা নদীর উৎসমুখ কলামে লেখা হয়েছে ভারত (ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ)। এতে উপজেলাগুলো ভারতভুক্ত বলে মনে হবে। এ রকম ভুল রয়েছে অন্তত ৫৫টি নদীর ক্ষেত্রে। যমুনা দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীর একটি হলেও এর উৎসমুখ বা পতনমুখ কিংবা জেলা-উপজেলার উল্লেখ নেই। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দেখানো হয়েছে হিমালয় ও দেওয়ানগঞ্জের উজানে।
এছাড়া রাজধানী ঢাকার উত্তরখান, খিলক্ষেত, গুলশান, তেজগাঁও ও ডেমরাকে এবং কর্ণফুলী, বাকলিয়া ও পতেঙ্গাকে বলা হয়েছে উপজেলা।
ডাকাতিয়া নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চাঁদপুর ও কুমিল্লা জেলার একটি নদী। অথচ নদী কমিশনের তথ্যমতে এটি চট্টগ্রাম জেলায়।
তালিকায় থাকা ৭৮১ ও ৮১২ ক্রমিকে গড়াই নদীর নাম দুইবার উল্লেখ করা হয়েছে। নদী দুটির উৎসমুখ, পতনমুখ ও দৈর্ঘ্য একই। উপজেলা কলামে উপজেলার নামও একই। হরিহর নদীর পতনমুখ হাপরখালী নদী দেখানো হয়েছে। কিন্তু ৯০৭ নদীর তালিকায় হাপরখালী নদী নামে কোনো নদী রাখা হয়নি। আড়পাঙ্গাশিয়া শুধু কয়রা উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অথচ এর দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে নদীরক্ষা কমিশন যে তালিকা করেছে। আমরা মনে করি এটা একটি আনাড়ি কাজ হয়েছে। নদীর তালিতা তো প্রতিটি জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছেও আছে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) কাছেও আছে। স্থানীয় নদীর কাছে যত লোক আছে তাদের কাছেও আছে। কাজ ছিল তাদের দিয়ে স্থানীয় খাল বা নদীগুলোকে উদ্ধার করা। সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে স্থানীয় অনেক নদীকে বাদ দিয়েছে। এ কাজটা করতে গেলে উচিত ছিল বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়), নদী বিশেষজ্ঞ, পানি বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত করা।
তিনি বলেন, ‘এমনিতেও আমরা দখলদারদের যন্ত্রণায় নদীগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারছি না। নতুন করে যদি কিছু নদীকে বাদ দিয়ে দিই তাহলে দখলদাররা বলবে এটা নদীর তালিকায় নেই। আমরা এটাকে জলমহাল করব। পরবর্তী সময় এটা যে যেভাবে পারবে দখল করে নেবে। বাংলাদেশকে এর জন্য বড় খেসারত দিতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা যে তালিকা তৈরি করেছি এটা খসড়া তালিকা। এই তালিকা নিয়ে যদি কারও কোনো মতামত বা আপত্তি থাকে, তাহলে লিখিতভাবে কমিশনকে জানাতে কমিশন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিলাম। কিছু ভুল আমাদের নজরেও এসেছে। কিন্তু একটা গোষ্ঠী বিশেষ করে কিছু এনজিও এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে। নদী কমিশনের তালিকা নিয়ে যে তথ্য প্রচার করা হচ্ছে তা মিথ্যা।’
নদীর সংজ্ঞা নিয়ে সমালোচনাকারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা কি নদী কমিশনের দেওয়া সংজ্ঞা পড়ে দেখেছেন? আমরা যে তালিকা করেছি এটা শতভাগ পারফেক্ট এটা বলা যাবে না। হয়তো ভূমি অফিস থেকে একটা নদীকে খাল বলা হয়েছে। সেটা খাল হিসেবেই আছে। আমরা যখন অভিযোগ পাব সেটা তখন সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসিকে জানাব। তারা তদন্ত করে সঠিক তথ্য সরবরাহ করবে।’ বিতর্ক সত্ত্বেও তিনি তালিকা করার জোর দিয়ে বলেন, ‘এখন আমাদের খসড়া তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সেটা আজ প্রকাশ করা হবে।’