ধোলাইখাল কি ফিরবে?

ইট-পাথরের জঞ্জাল, লোহা-লক্কড়ের অগুণতি ঘিঞ্জি দোকানপাট, যানজট- সব মিলিয়ে পুরান ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা ধোলাইখাল। তবে নামের সঙ্গে খাল রয়ে গেলেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভার।

অথচ এই খাল এক সময় বহিঃশত্রুর হাত থেকে প্রাচীন ঢাকাকে দিয়েছে সুরক্ষা, চলেছে বড় বড় নৌযান, ফি বছর নৌকাবাইচ জুগিয়েছে বাসিন্দাদের আনন্দের খোরাক।

ঢাকার কলেবর যত বেড়েছে, যত আধুনিকতার পথে হেঁটেছে, তার সঙ্গে একটু একটু করে হারিয়েছে ধোলাইখাল। পুরনো খালের মাত্র ৫ শতাংশ টিকে থাকলেও দূষণ ও দখলদারিতে সেটুকুও অস্তিত্ব হারাচ্ছে।

ঢাকার প্রথম সুবেদার ইসলাম খান ১৬০৮-১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ধোলাইখাল খনন করিয়েছিলেন। খালের নামে এলাকার নামও ধোলাইখাল রাখা হয়। খালটি খননের উদ্দেশ্য ছিল যাতায়াত সুবিধা বাড়ানো ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়াসহ ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন।

এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ফরাশগঞ্জ, নারিন্দা, মৈশুণ্ডি থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বর্ষাকালে নৌকায় চড়ে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিতে আসতেন।

যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ বইয়ে এই খালের বিবরণ দেওয়া হয়েছে, ‘এই খাল বালু নদী হইতে বহির্গত হইয়া ঢাকা ফরিদাবাদের নিকটে বুড়িগঙ্গার সহিত মিলিত হইয়াছে। এই খালের একটি শাখা ঢাকা শহরের মধ্য দিয়া বাবুবাজারের নিকটে বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রবেশ লাভ করিয়াছে।’

অস্তিত্ব বিলীনের শুরু

স্বাধীনতার পরের নতুন মানচিত্রেও ধোলাইখালের অস্তিত্ব ছিল। গত শতকের আশির দশকে রায় সাহেব বাজার মসজিদের পাশে ছিল নৌকার ঘাট। নব্বই সালেও মানুষ নৌকা দিয়ে ঘাটে আসত।

মানচিত্রে দেখা যায়, রায়সাহেব বাজারে চিত্রা সিনেমা হলের সামনে থেকে শুরু হয়ে টং মার্কেট, সাদেক হোসেন খোকা মাঠ, মুর্গিটোলা মোড় দিয়ে খালের একটি অংশ কাঠের পুল-লোহার পুল এলাকা হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিলিত হয়েছে। সাদেক হোসেন খোকা মাঠের মোড় থেকে যায় যাত্রাবাড়ীর দিকে এবং অপর অংশ ধোলাই পাড়ে গিয়ে মিলিত হয়।

ধোলাইখালের দুটি অংশ। একটি অংশ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, ওয়ারী হয়ে দয়াগঞ্জ বাজার পর্যন্ত মোট ৫.১০ কিলোমিটার। দ্বিতীয় অংশ দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু থেকে ধোলাইখালের আগের অংশের সঙ্গে মিশেছে- এই অংশ ১.৯৭ কিলোমিটার।

খালের অস্তিত্ব বিলীন হছে বক্স কালভার্ট ও রাস্তায়, দুই প্রান্তে পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য খালের দুটো খোলা মুখ। এই খালকে আগের অবস্থায় ফেরানোর আর সুযোগ নেই।

১৯৭০ সালের ধোলাইখাল, ছবিটি রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজের কাছ থেকে সংগ্রহ করা।
১৯৭০ সালের ধোলাইখাল, ছবিটি রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজের কাছ থেকে সংগ্রহ করা।

১৯৭০ সালের ধোলাইখাল, ছবিটি রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজের কাছ থেকে সংগ্রহ করা।

উত্তর মৈশুণ্ডির বাসিন্দা চিত্তরঞ্জন দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ধোলাইখাল সেটা তো এখন নামে আছে, বাস্তবে নেই।এক সময় এখানে বিল ছিল, নৌকাবাইচ হত। কিন্তু সেই খাল বা বিল আর নেই। প্রথমে ছোট ছোট টং বসিয়ে ব্যবসা করেছিল অনেকে। সেখানে এখন গড়ে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা। এসব অবৈধভাবে বিভিন্ন সময় দখল করে নিয়েছে।”

কাগজপত্রে প্রায় ১০০ ফুটেরও বেশি প্রশস্ত এই খাল বাস্তবে প্রায় পুরোটাই দখল হয়ে গেছে। কোনোমতে টিকে আছে ২৫-৩০ ফুট। খালের আয়তনও কমে গেছে অনেক। ময়লায় ভরাট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি খালের পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে দোকান, বাড়ি আর রাস্তা। লোহার পুল থেকে, অর্থাৎ জহির রায়হান অডিটোরিয়াম থেকে শুরু করে কেশব ব্যানার্জি রোডসংলগ্ন এবং মিল ব্যারাকের পাশ ঘেঁষে খালের যে উন্মুক্ত অংশ আছে, সেটুকুও আবর্জনায় ভরাট; আর দুই পাশের ভরাট জায়গাও দখল হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। খালের সামান্য যে পানি, সেই পানিও নোংরা, দূষণে দুর্গন্ধময়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে ছোট এই খালটি। এই ওয়ার্ডের লোক সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজারের বেশি। আবর্জনা ফেলে খাল ভরাট করে এরইমধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে অন্তত ৫০টি অস্থায়ী দোকান।

১৯৮৭ সালে ‘পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পে’র অধীনে রায় সাহেব বাজার মোড় থেকে উন্মুক্ত খাল ভরাট করে রাস্তা ও বক্স কালভার্টের প্রকল্প সুপারিশ করা হয়। বক্স-কালভার্ট হওয়ার পর যাত্রাবাড়ী, পুলিশ লাইন্স ব্যারাক, কেশব ব্যানার্জি রোড, আর কে দাস রোড, আলমগঞ্জ রোড, সূত্রাপুর, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ এলাকার সব নালা যুক্ত হয়েছে তাতে।

কবে নাগাদ এই খাল ভরাট শুরু হয়েছে জানতে চাইলে কেশব ব্যানার্জি রোডের স্থানীয় বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব তপন দে বলেন, “আমার বাবা, আমার জন্ম এই এলাকাতেই। ছোটবেলায় এই খালে আমরা গোসল করতাম। স্বাধীনতা দিবসে ৫২ মাঝির নৌকাবাইচ হত।

“নব্বই সালেও খাল ছিল। এরপর সব দখল হয়ে গেছে। খালের জায়গায় রাস্তা, দোকান পাট, ঘরবাড়ি হয়ে গেছে। যে যার মতো দখল করে নিয়েছে। এখন অল্প যে অংশ, সেটাও অপরিচ্ছন্ন। ময়লার কারণে পানি বের হতে পারে না। খালের আশপাশের সব জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে।”

প্রায় তিন যুগ আগের ‘পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পে’ কাজ করা সিটি করপোরেশনের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা জানান, ঢাকা সিটি করপোরেশন এই খালের উপর বক্স কালভার্ট করেছে। বক্স কালভার্টের উপরে রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। তখন খালে পানি প্রবাহ বেশ ছিল। বক্স কালভার্ট করার কারণে মানুষের যাতায়ত ও আবাসন ভালো হলেও সেখানে এখন পানি প্রবাহ না থাকায় জলাবদ্ধতা বেড়ে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রকৌশলী জানান, ১৯৮৭ সালে নারিন্দা মোড় থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত এবং ধলপুর কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত ৪.৫ থেকে ৫ কিলোমিটার খাল বক্স কালভার্ট করার জন্য একটি প্রস্তাবনা বিশ্ব ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়। তাদের পরামর্শে একটি প্রজেক্ট পাস হয়। ১৯৯৬ সালের মার্চ থেকে কাজ শুরু হয়। ২০০৫ সালে এই প্রজেক্টের কাজ শেষ হয়। এর মধ্য দিয়ে খালের তিনটি দিকে তিনটি বক্স কালভার্ট হয়েছে।

কবে থেকে খাল হারিয়ে গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটা বলতে পারেন ১৯৯৩ সাল থেকে। যখন প্রজেক্ট পাস হয়েছে তখন থেকে নানা কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। ফাইনালি খাল বন্ধ হয়েছে ১৯৯৬ সালের মার্চ থেকে।”

কাগজপত্রে ১০০ ফুটেরও বেশি প্রশস্ত এই খাল এখন কোনোমতে টিকে আছে।
কাগজপত্রে ১০০ ফুটেরও বেশি প্রশস্ত এই খাল এখন কোনোমতে টিকে আছে।

কাগজপত্রে ১০০ ফুটেরও বেশি প্রশস্ত এই খাল এখন কোনোমতে টিকে আছে।

খাল প্রশ্রস্ত কেমন ছিল, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আসলে নদী দখল হতে হতে সেটা খালে পরিণত হয়েছে। জায়গা অনেক ছিল, আস্তে আস্তে ছোট হয়েছে। সর্বশেষ আমরা বক্স কালভার্ট করেছি ২.২৫-৩ মিটার। এটা হল তলদেশের অংশ। বাকি অংশ বলতে হলে পুরুটাই এখন রাস্তা। আশপাশে এখন বড় বড় বিল্ডিং।”

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকার ধোলাইখালের উপর ১০টি ব্রিজ ছিল। ব্রিজের উপর দিয়ে লোকজন চলাচল করত, যানবাহন চলাচল করত। নিচ দিয়ে নৌকা চলত। সে সময় পানি প্রবাহ ছিল অনেক বেশি।”

বক্স কালভার্ট যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, সেটা বাস্তবে কাজে আসেনি বলে মনে করেন এই গবেষক।

তিনি বলেন, “যানজটতো কমেনি, বরং বেড়েছে। এখন এই খালকে নতুনভাবে আংশিক উন্মুক্ত করলে খালের মধ্যে সংযোগকারী ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে আগে ঠিক করতে হবে। স্যুয়ারেজের পানি কীভাবে খালে পড়বে সেটা আগে ঠিক করতে হবে।

“খালগুলোকে উন্মুক্ত করে উপর দিয়ে গাড়ি চলাচলের জন্য প্রয়োজনে বেইলি ব্রিজ করতে হবে, যাতে করে উপর দিয়ে গাড়ি চলে এবং নিচ দিয়ে পানি প্রবাহ থাকে।”

কী করছে সিটি করপোরেশন

সম্প্রতি ঢাকার পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে পাওয়ার পর বিভিন্ন খাল উদ্ধারে নেমেছে সিটি করপোরেশন।

পরিবর্তিত পরিস্থিতে ধোলাইখাল নিয়ে পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, “খালের প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে আমরা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালাচ্ছি। আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করছি। মোট কথা খালের প্রবাহ আমরা ফিরিয়ে আনব।

“আর বক্স কালভার্টের বর্জ্য প্রতিনিয়ত যেন পরিষ্কার করা হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এতে আমরা জলাবদ্ধতা নিরসন করতে পারব বলে আশা করছি।”

সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে খালের উপর বক্স কালভার্ট করা হয়েছে।

“সেটা অনেক আগের কথা। বিস্তারিত এই মুহূর্তে বলা কঠিন। এখন কিছু অংশ খাল হিসেবে রয়ে গেছে। সেটা আমরা ওয়াসার কাছ থেকে নিয়ে কাজ শুরু করব।”

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, “আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন মাসের ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ শুরু করেছি। এর আওতায় পান্থপথ, সেগুন বাগিচা, জিরানি, শ্যামপুর, মাণ্ডা ও ধোলাইখালের বক্স কালভার্ট মেরামত, অপসারণ, দখল উচ্ছেদ করার মাধ্যমে পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে। আগামী মার্চের মধ্যে এই কার্যক্রম সম্মন্ন করার দৃঢ় প্রয়াস আমার রয়েছে।

“পরবর্তিতে ধোলাইখালসহ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্যান্য খালগুলোকে ৩০ বছর মেয়াদি ‘ইন্টিগ্রেটেড মাস্টারপ্ল্যান ফর ঢাকা সিটি’র আওতায় দখলমুক্ত করে খালগুলোর সৌন্দর্য বাড়িয়ে নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে।”

মূল উৎসঃ ধোলাইখাল কি ফিরবে? (bdnews24.com)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *