বাংলাদেশের নদীগুলো বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে

এক শ্রমিক ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে প্লাস্টিক শীট সংগ্রহ করছেন। ৯ জানুয়ারী, ২০২৩। (ছবি মুনির উজ জামান / এএফপি)
এক শ্রমিক ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে প্লাস্টিক শীট সংগ্রহ করছেন। ৯ জানুয়ারী, ২০২৩। (ছবি মুনির উজ জামান / এএফপি)

যদিও হিমালয় থেকে নদীর জলের স্রোতে বয়ে আসা পলি জমে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু এই নদীর দেশে নদীগুলোই আজ মৃতপ্রায়।

উজানের পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারনে মারা গেছে দেশের অধিকাংশ ছোট নদী। অনেক নদী আজ আর মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর যেসব নদীতে পানি প্রবাহ রয়েছে সেগুলোওঁ দখল ওঁ দূষনের শিকার হয়ে ধুকছে। নদীর দেশে নদীই আজ বিপন্ন।

সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও স্বাধীনতার পরে শতাধিক নদী হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। ১৯৬৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে নদ -নদীর সংখ্যা কতো কমল, সেই সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা ২০১০ সালে প্রকাশ করে বাংলাদেশ দূর্যোগ ফোরাম। সে গবেষণায় বলা হয়, দেশের ১১৫টি নদী হয় মারা গেছে নয়তো হয়ে গেছে মৃতপ্রায়।

কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা, দায়িত্বহীনতা এবং ক্ষমতাশালী লোকজনের লোভের বলি হয়ে যেসব নদী অবশিষ্ট আছে সেগুলোওঁ ধুকছে । কিছু কিছু নদী কলকারখানার বর্জ্যে দূষিত হতে হতে পরিণত হয়েছে কলো রংয়ের ক্যামিকেল বর্জ্যের প্রবাহে।

রিভার্স এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার – বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা এবছরের আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসে (১৪ মার্চ) নদী দুষণ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে – মাত্র দু’দশক আগেওঁ নদী দুষন ছিল একান্তই ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো বড় শহর কেন্দ্রিক সমসা। কিন্তু সে দূষণের বিস্তার ঘটেছে এমনকি গ্রাম পর্যায়ে।

সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের সবচে দুষিত নদী এখন আর ঢাকার আশেপাশের কোন নদী নয় বরং সিলেট বিভাগের সুতাং নদী কারখানা বিষে জর্জরিত সবচে দুষিত নদীর তকমা পেয়েছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাছাই করে ঢাকা খুলনা সিলেট, রাজশাহী রংপুর বরিশাল এবং চট্টগ্রাম বিভাগে সংস্থাটি ৫৬ নদীতে বছর ব্যাপী সমীক্ষা চালায় আরডিআরসি।

এসব ৫৬টি নদীর ১৯ টি ঢাকা বিভাগে, ৭টি খুলনার, সিলেটের ৫টি, চট্টগ্রামের ৮ টি রাজশাহির ২টি, বরিশালের ১১টি এবং রংপুরের ৪টি নদী রয়েছে। জরিপকৃত সবগুলো নদীই হয় শিল্প কারখানা নয়তো গৃহস্থালী বর্জ্য বা প্লাস্টিক দূষণের শিকার।

জরিপের ফলাফল অনুযায়ি শুস্ক মৌসুমে পানিতে দ্রবীভুত অক্সিজেনের পরিমান ৫৬ টির মধ্যে ২৫ টিরই ৫ মিলিগ্রামেরও কম। তার মানে সেখানে মাছ বা জলজ প্রানী টিকে থাকার মতো আদর্শ পরিবেশ নাই।

ঢাকা ও নারায়নগঞ্জের নদীগুলো একাধারে শিল্পকারখানা ও গৃহস্থালী বর্জ্যের শিকার হয়ে বহুবছর ধরে মৃত। নদীর জলের রং শুস্ক মৌসুমে পিচের মতো কালো রং ধারণ করে।

এরমধ্যে বুড়িগংগা, টংগী খাল (নদী), শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, গাজিপুরের লবনদহ, নরসিংদীর হাড়িধোয়া, সিলেটের সুতাং এবং বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমান প্রতিলিটারে ১ মিলিগ্রামেরও কম।

ঢাকার বালু ও তুরাগ নদীতে অক্সিজেনের পরিমান অক্সিজেনের মাত্রা ২ মিলিগ্রামের কম । তার মানে এ সবগুলো নদীর জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে গেছে।

বরিশাল বিভাগের উপকুলীয় অঞ্চলে্র জরিপকৃত – রামনাবাদ, আন্ধারমানিক খাপরা ভাংগা ও বলেশ্বর নদীতে অক্সিজেনের মানমাত্রা ঠিক থাকলেও সেখানে রয়েছে মারাত্বক প্লাস্টিক দূষণ।

৫৬ টি নদীর মধ্যে ১৬ টি গৃহবর্জ্য ও প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণের শিকার।

এ সংস্থারই আর একটি জরিপে দেখা গেছে শুধুমাত্র তুরাগ নদীর দুষণের কারনে – নদীর দুপাড়ের ৩৩ টি জেলে পল্লীর লোকেরা জীবিকা হারিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

আরডিআরসি এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, এসব জেলে পল্লীর লোকেরা বর্ষার তিন চার মাস ছাড়া তুরাগে মাছ ধরতে পারে না। দুষনের শিকার হয়ে নদীপাড়ের জেলে পল্লীর লোকজন খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে।

খোদ ঢাকা শহরের বসিলা বা সাভারের জেলে পল্লীর অধিকাংশ লোকই এখন তাদের পুর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ এখন স্থানীয় বাজারে মাছের ব্যবসা করেন আবার কেউ কেউ কাজ করেন দিনমজুর হিসাবে।

সাভারের বটতলার জেলেপাড়ায় কথা হলো রনজিত রাজবংশীর, ৫৫, সাথে। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে তিনি শীতলক্ষ্যা নদীতে মাছ ধরেন। কিন্তু এখন সে পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

“বিশেষ করে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা গুলো সাভারে স্থানান্তর হওয়ার পর নদী পুরোপুরি দূষিত হয়ে পড়েছে।“

তার ছেলে স্থানীয় বাজারে মাছের ব্যবসা করেন। আর তিনি গত কয়েকবছর ধরে বেকার জীবন যাপন করছেন।

“আমরা মাছ ধরা ছাড়া কিছু শিখি নাই। তাই অন্য কাজও এই বয়সে করতে পারি না,” রঞ্জিত বলেন।

স্থানীয় গার্মেন্টস কারখানাগুলো এবং ট্যানারি প্রতিদিনই নদীতে তরল বর্জ্য ফেলছে। ফলে নদীর পানি পরিনত হয়েছে ঘন কালো তরল বর্জ্যে, তিনি বলেন।

নদী রক্ষায় সরকারের অংগীকার থাকার পরও কেন নদীগুলোকে রক্ষা করা যাচ্ছে না – জিজ্ঞাসা করলে আরডিআরসি’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, সরকার তার সমস্ত ভবিষ্যত উন্নয়ন পরিকল্পনা করছে নদীর কথা মাথায় রেখে।

“সে জন্যই সরকার ডেলটা প্লান ২১০০ প্রনয়ন করেছে। ২০১৩ সালে যে বাংলাদেশ পানি আইন করেছে সেটাতেও নদীরক্ষার অংগীকার স্পস্ট আছে। কিন্তু সমস্যা বাস্তবায়নে । সরকারের এই স্বদিচ্ছা কোনভাবে স্থানীয় পর্যায়ে যারা বাস্তবায়ন করবে তাদের কাছে পৌচ্ছাচ্ছে না।

তারা সরকারের এই প্রায়োরিটির জায়গাটা জরুরীভাবে বাস্তবায়ন করছে না, এজাজ বলেন।

যদিও হাইকোর্ট ২০০৯ সালে সরকারকে নদীগুলোকে দখল ও দুষণের হাত থেকে রক্ষা করে নদীকে জীবন ফিরিয়ে দিতে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেয়।

নির্দেশনা গুলোর মধ্যে – নদীতে কলকারখানা ও গৃহস্থালী বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা, নদীগুলোকে দখলদার হাত থেকে নদীর দখলকৃত জায়গা উদ্ধার করে নদীর পাড়ে সীমানা পিলার বসিয়ে দেওয়া ছিল অন্যতম।

কিন্তু নির্দেশনার পর ১৪ বছর পার হয়ে গেলেও সরকার এখন পর্যন্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে একটি নদীও উদ্ধার করে কোন উদাহরণ তৈরি করতে পারে নাই। নদী দূষণও বন্ধ হয় নাই।

বরং সরকারী বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা প্রকারন্তরে দখলদারদের সাহায্য করছেন।

শরিফ জামিল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারন সম্পাদক এবং ইন্টারন্যাশনাল রিভারকিপার, বাংলাদেশ প্রতিনিধি এবং নদী রক্ষা আন্দোলনের সাথে বহু বছর ধরে জড়িত। নদী নিয়ে সরকারের অংগীকার এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরওঁ কেন কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আসলে সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তারা নদী ধংসের জন্য কাজ করেছে, তাদেরকেই নদী রক্ষার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই নদীগুলো রক্ষা পাচ্ছে না।

যেমন, যেসব সরকারি কর্মকর্তারা নদীর জায়গা দখলে দখলদারের সহায়তা করেছে, তাদেরকেই নদীর সীমানা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা স্বভাবতই দখলদারের দখল করা জায়গা বাদ দিয়ে নদীর সিমানা নির্ধারণ করছেন।

“কিন্তু একজন সরকারি কর্মকর্তাও তাদের এইসব কর্মকান্ডের জন্য শাস্তি পায় নাই। এমন কি যারা দখল দুষন করছে তাদেরকেও কোন রকম জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে না,” শরিফ জামিল বলেন।

“আইনের বাস্তবায়ন না হওয়াই হচ্ছে, নদী রক্ষার প্রধান বাধা,” তিনি বলেন।

নদী রক্ষনাবেক্ষন করার জন্য – সরকার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নামে একটি কমিশন প্রনয়ন করেছে। কিন্তু সে কমিশনওঁ কোন কার্যকারী ভুমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

নদী রক্ষা কমিশন তাদের ২০১৯ সালে বার্ষিক প্রতিবেদনে সারা দেশে মোট ৬৬ হাজার দখলদার চিণহিত করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। কিন্তু গত তিন বছরে নদী রক্ষা কমিশন নতুন কোন বার্ষিক প্রতিবেদনওঁ প্রকাশ করছে না।

মূল উৎসঃ বাংলাদেশের নদীগুলো বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে (voabangla.com)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *