বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নদীগুলো অবাধে দখল-দূষণ হচ্ছে। কিন্তু সব খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় না। তাই নদী রক্ষায় হটলাইন খুবই জরুরি।’
বিশ্ব নদী দিবস-২০২৩ উপলক্ষে ঢাকার আগারগাঁওয়ের পর্যটন ভবনে গত শনিবার আয়োজিত আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি। এবারের বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নদীর অধিকার’।
সভায় সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনাকালে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘নদী অধিকার মনুষ্যকেন্দ্রিক। কিন্তু, নদী এখন দূষণকারী, দখলদার আর বালুখেকোদের সম্পত্তি হয়ে গেছে। নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর তালিকা সংশোধন করতে হবে। নদী রক্ষায় হেলথ কার্ড গঠন করতে হবে দূষণের অবস্থা পরিলক্ষণ করতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএর একসঙ্গে কাজ করে জাহাজ বা পর্যটন এলাকায় প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করতে হবে।’
নদী রক্ষায় সচেতনতা তৈরি করতে পৃথিবীর ১০০টিরও বেশি দেশে প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববারকে নদী রক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে এ দিবস পালিত হচ্ছে।
সভার উদ্বোধনী বক্তব্যে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও, নদীর সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। নদীকে জানতে হলে নদীতে যেতে হবে, ঘুরতে হবে, নদীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হতে।’
আরডিআরসি চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, ‘নদীর মূল মালিক হচ্ছে নদী পাড়ের মানুষ, যারা নদীর ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্তমানে নদী দূষণ বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারণে নদী তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে, নদীর প্রাণবৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন।’
সভায় দেশের বর্তমানে সবচেয়ে দূষিত নদী তুরাগ, লবনদহ, হাড়িধোয়া, সোমেশ্বরী ও সুতাংয়ের ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শন করেন বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন।
কমিউনিটি আলোচনায় নরসিংদী পরিবেশ আন্দোলনের সম্পাদক প্রলয় বলেন, ‘হাড়িধোয়া নদীতে একসময় ট্রলারে ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু এখন দখল-দূষণে নদীর পাড়েই যাওয়া যায় না। নরসিংদীর শিল্পাঞ্চলের কবল থেকে নদীকে রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।’
পবা পুরান ঢাকার কর্মী সেলিম বলেন, ‘বুড়িগঙ্গা দিয়ে একসময় কামরাঙ্গীর চর খেলতে যেতাম। কিন্তু নদীতে এখন দূষণের কারণে পাশেও যাওয়া যায় না।’
মৎস্যজীবি সম্প্রদায়ের প্রধান নিত্য রাজবংশী বলেনও, ‘একসময় ঢাকার নদীগুলোতে মাছ ধরে ভালোভাবে জীবনধারণ করতে পারতাম। কিন্তু দূষণের কারণে বর্তমানে জেলেরা তিন-চার মাস মাছ ধরে, আর বাকি সময় বেকার।’
আয়োজনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, ‘আমার নানার বাড়ি শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে। নদীতে সাঁতার শিখতাম। কিন্তু দূষণের কারণে সেই নদী এখন হুমকির মুখে। নদী আবেগের জায়গা, শিরা-উপশিরার মতো। আমি নৌবাহিনীর হওয়ায় নদীর প্রতি ভালোবাসা আছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে শিপবিল্ডিংয়ের কারণে নদী দূষণ হচ্ছে। দূষণের অন্যতম উৎস ভূমি। জাহাজ থেকে হয় পাঁচ থেকে সাত শতাংশ। দূষণ সীমিত রাখতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকায় ১৩০টি দূষণের উৎসমুখ চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো বন্ধ করলে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিল্পকারখানাগুলোকে আইন মেনে বর্জ্য নিঃসরণ করতে হবে। পরিবেশ আন্দোলনকারী সবাইকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। বিআইডব্লিউটিএ আইনের সহায়তা নিয়ে কাজ করে।’
‘নদী রক্ষা কমিশনের খসড়া তালিকার পাশাপাশি আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি সিএস ম্যাপ ধরে নদীর পথ তৈরির জন্য। পাইলট প্রকল্প চলমান রয়েছে নদীর প্লাস্টিক দূষণ নিরসনে। এক মাসের মধ্যে সব বন্দরে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা হবে’, যোগ করেন তিনি।
রিভার বাংলার সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘নদী সুরক্ষায় আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে নিতে হবে। বিরামহীনভাবে লড়াই করতে হবে।’
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা আমাদের সুন্দর সুন্দর নদীগুলোকে মরতে দিতে পারি না।’
বেলার উদ্যোগে ইউএসএআইডির সহায়তায় অনুষ্ঠানটির যৌথ আয়োজনে ছিল বাংলাদেশ নাগরিক আন্দোলন, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি), বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল, ন্যাচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্ট, নদী অধিকার মঞ্চ, রিভার বাংলা, পরিবেশ ও নদী রক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডি, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও নোঙর ট্রাস্ট।
মূল উৎসঃ ‘আমাদের সুন্দর সুন্দর নদীগুলোকে মরতে দিতে পারি না’ | The Daily Star Bangla