নদী রক্ষা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লক্ষ্য হওয়া উচিত: আনু মুহাম্মদ


নদী রক্ষা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যারা নদী দখল করে তারা বড় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক। তাই এটি রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডায় আসে না। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উপর চাপ দিতে হবে।

আজ শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে “দখলের গ্রাসে সুটকি নদীর ২৬ কিলোমিটার. ৫০ বছরে নদী লুট ঠেকাতে নাগরিক আহবান” শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ-পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ একথা বলেন।

হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন, নোঙর, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন এবং ইনিশিয়েটিভ ফর পিস যৌথভাবে উক্ত অনুষ্ঠান আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন ও ইনিশিয়েটিভ ফর পিস এর চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শফিকুর রহমান। তিনি ২৩ মে কে জাতীয় নদী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের আহবান জানান। এছাড়াও নদীভিত্তিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও শিশুদের মধ্যে নদী সচেতনতা সৃষ্টিতে গবেষণা প্রচলনের ঘোষণা প্রদান করেন।

আনু মুহাম্মদ তার বক্তব্যে আরো বলেন, সুটকি নদী দখলদারিত্বের একটি প্রতিনিধিত্ব মাত্র। সারা দেশে এমন আরো বহু ঘটনা ঘটছে। নদীকে দেখার জন্য আমাদের আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো সেরকমভাবে তৈরি হয়নি। শীতলক্ষ্যার পাড়ে আমরা এখনো দেখছি শুধু সিমেন্ট কারখানা। জিডিপি বৃদ্ধির সাথেও নদী দখল জড়িত। কিছুদিন আগে এক মন্ত্রী বললেন, এতো চওড়া নদীর দরকার নেই। নদী ভরাট করে জমি বানাতে হবে। অতীতে নদী নিয়ে আন্দোলনকারীকে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়েছে এদেশে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দেশের সামগ্রিক নদী প্রশাসনের অবস্থা বেশ ঘোলাটে। ভরাট, দখল, উচ্ছেদ প্রক্রিয়া সবই যেনো টাকার খেলা। নদী রক্ষা করতে হলে সাহসিকতা ও সততার সাথে কাজ করতে হবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, আইনের অনেক অপব্যাখ্যা হচ্ছে। কিন্তু সংসদে নদীর স্বার্থের পরিপন্থী কোনো আইন এখনো পাশ হয়নি। নদী রক্ষা কমিশনের তেমন ক্ষমতা নেই, ফান্ডও নেই। প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হকের দখল থেকে উদ্ধারকাজও ঠিকমতো হয়নি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র’র সাবেক প্রধান নির্বাহী শীপা হাফিজা বলেন, সুটকি দখলদারিত্বে লোকটির দূরদর্শিতা আছে। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। আমাদেরকে এসব দখলদারিত্ব উচ্ছেদে নেটওয়ার্ক বাড়াতে হবে এবং তরুণদের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে একাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন প্রখ্যাত দার্শনিক ও গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা, নোঙর বাংলাদেশ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামস প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে শুটকি নদী সম্পর্কে বলা হয়েছে – নদীর নাম ‘শুটকি’; অবস্থান হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলা। নদীটি উজানে খোয়াই এবং ভাটিতে যমুনা নদীর সাথে যুক্ত। দীর্ঘ প্রবাহিত এ নদীটি দিয়ে এখনো হবিগঞ্জ হতে ধান বোঝাই নৌকা যমুনা নদীতে যায়। অথচ এই নদীতে মাছ ধরতে গেলেই নদীর তথাকথিত মালিক বন্দুক হাতে তেড়ে আসে, নিজ সুবিধা হাসিলের জন্য নদীর বিভিন্ন স্থানে সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বাঁধ তৈরি করেছে। জনগণের সম্পদের উপরে এই চরম আগ্রাসী কার্যক্রম নজিরবিহীন।

সুলতানি ও মোঘল আমলে নদী ও ভূমির মালিকানা সর্বশক্তিমান আল্লাহর বিবেচিত হত। ১৭৯৩ সালে ইংরেজ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনবলে জমিদার ও তালুকদাররা নদী ও ভূমির মালিকানা পান। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল করা হলে নদী ও ভূমির মালিকানা সরকারের উপর বর্তায়। কিন্তু হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে অবস্থিত জমিদার পরিবার শুটকি নদী যাতে আবার নিজেদের দখলে নিতে পারে সেজন্য ১৯৬০ সালে তারা ইয়াহিয়া ফিশারিজ প্রাইভেট কোম্পানি নামক একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। পাকিস্তানি আমলে তারা নদীর দখল না পেলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে শুটকি নদীকে বিল দেখিয়ে এর ভূমির নামজারি, দখল ও ভোগের দাবি করে ইয়াহিয়া ফিশারিজ প্রা. কোম্পানির পক্ষে দেওয়ান ইয়াহিয়া রাজা একটি স্বত্ব মামলা দায়ের করে। ১৯৭৩ সালে সিলেট সাব জজ আদালত তার পক্ষে রায় দেন।

১৯৯২ সালে সিলেট জেলা প্রশাসন রিভিউ মামলা করে ইয়াহিয়া রাজার নামজারি আদেশ বাতিল করে সরকারের নামে রেকর্ড পুনর্বহাল করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ঐ আদেশের বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালে ইয়াহিয়া রাজা হবিগঞ্জ যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আবার স্বত্বজারী মামলা দায়ের করেন। ২০২১ সালে প্রদত্ত মামলার রায়ে তিন মাসের মধ্যে মামলার বিবাদীদের নামে নামজারী করার আদেশ দেয়া হয় অন্যথায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সাবেক ও তৎকালীন ছয় কর্মকর্তাকে তিন মাসের দেওয়ানী কয়েদে (সিভিল জেল) আটক রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। শাস্তির এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ হতে রিভিশন মোকদ্দমা এবং শুটকি নদী সরকারিভাবে ইজারা দেয়ার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া ফিশারিজের পক্ষ হতে একটি রিট পিটিশন এখনো চলমান।

এমনি এক অবস্থায় অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসে ভূমি মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালের ২৬ জুলাই শুটকি নদীকে বদ্ধ জলাশয় দাবী করে জেলা প্রশাসনকে লিজ দেয়ার নির্দেশ দেয় এবং সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসন ছয় বছরের জন্য ইজারা প্রদান করে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নদ নদীর তালিকায় শুটকি নদীর নাম রয়েছে। কিন্তু দখলকৃত নদীর তালিকায় এই নদীর নাম নেই, দখলদারের তালিকায়ও ইয়াহিয়া ফিশারিজ বা এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান আহমদ রাজার নাম নেই। অথচ গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে দেওয়ান আহমদ রাজা বংশানুক্রমিকভাবে সুটকি নদীর মালিক হিসাবে দাবী করে থাকেন এবং নদীটিকে খাল হিসাবে দাবি করে তা তাদের পূর্বপুরুষরা খনন করেছেন মর্মে বিবৃতি দিয়ে থাকেন। দখলদার প্রতিষ্ঠান প্রধানের বক্তব্য মতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৮ সালে হাওরের জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠানের লিখিত অনুমতি সাপেক্ষে সুটকি নদীর ৪ কিলোমিটার এলাকা খনন করে।

প্রাবন্ধিক জানান

১. হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার ‘সুটকি নদী’ একটি অসাধারণ নদী। দেশের প্রতিটি রেকর্ডে যা নদী হিসেবেই নিবন্ধিত এবং উল্লিখিত রয়েছে।
২. এতদসত্ত্বেও উক্ত নদীটি ১৯৭৩ সালে আদালতের রায়ে এবং তৎকালীন সিলেট জেলা প্রশাসনের চরম হঠকারিতায় ব্যক্তির মালিকানায় চলে যায়।
৩. এরই মাঝে পানি উন্নয়ন বোর্ড সরকারি টাকায় উক্ত নদীটি খনন করে এবং সেক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তিরই অনুমতি নেয়।
৪. আরো দুর্ভাগ্যজনক যে, হবিগঞ্জের বর্তমান জেলা প্রশাসক নদীকে “বদ্ধ জলাশয়” বানিয়ে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২৫ মাইল দীর্ঘ একটি নদী কিভাবে “বদ্ধ জলাশয়” হতে পারে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।
৫. ১৯৭৩ সালের পর অর্ধশতক অতিক্রান্ত হলো। সরকার আসলো, সরকার গেলো। আদালত বা সরকার উক্ত বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নিলো তা সুস্পষ্ট হলো না।
৬. উপরিউক্ত বিষয়টি আমলে আনয়ন করার জন্য এবং আপনার অবস্থান থেকে প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নদীকে নদীর মর্যাদায় এবং আদালত ঘোষিত “জীবন্ত সত্ত্বা” বিষয়টি কার্যকরণে আপনার সদয় হস্তক্ষেপ গ্রহণের বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

মূল উৎসঃ নদী রক্ষা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লক্ষ্য হওয়া উচিত: আনু মুহাম্মদ (shampratikdeshkal.com)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *