নদীদূষণ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র

দেশের অন্তত ৫৬টি নদী চরম দূষণের শিকার: জরিপ
নদীদূষণ, তুরাগ নদী

গত ১১ মার্চ রাজধানীর গাবতলী এলাকায় নদীতে একটি তেলবাহী ট্যাঙ্কারের সঙ্গে আরেকটি জাহাজের সংঘর্ষে তুরাগের প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ে। দুদিন পেরিয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষ এখনও তেল পরিষ্কার করতে পারেনি। তুরাগের মতো দেশের অন্তত ৫৬টি নদী রাসায়নিক বর্জ্য নিঃসরণ, ময়লা আবর্জনা ফেলা এবং তেল ছড়িয়ে পড়ার মতো বিভিন্ন কারণে চরম দূষণের শিকার হচ্ছে। ছবিটি গতকাল সোমবার তোলা। ছবি: রাশেদ সুমন/ স্টার

বছর বিশেক আগেও ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরেই কেবল নদীদূষণ দেখা গেলেও এখন এটি সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে।

নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদীগুলো প্রাকৃতিকভাবে পানিপ্রবাহ কম থাকা অবস্থায় চরম দূষণের শিকার হয়েছে।

ঢাকা, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল এবং চট্টগ্রাম বিভাগে নির্বাচিত ৫৬টি নদীতে বছরব্যাপী সমীক্ষাটি চালায় রিভারস অ্যান্ড ডেল্টা রিচার্স সেন্টার (আরডিআরসি)। এতে দেখা গেছে প্রতিটি নদীই দূষণের শিকার।

বেসরকারি সংস্থা আরডিআরসি নদী নিয়ে গবেষণা করে থাকে এবং এই গবেষণাটি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিচালিত হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জরিপের জন্য নদীগুলো তারা বেছে নিয়েছিল।

সংস্থাটি গাজীপুরের একটি গবেষণাগারে প্রতিটি নদীর পানির পিএইচ লেভেল, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন, ক্যামিকেল অক্সিজেন ডিমান্ড (সিওডি) এবং বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) পরীক্ষা করে।

যেকোনো মিশ্রনে অক্সিজেনের পরিমাপ হয় সিওডি দিয়ে। রাসায়নিকভাবে কোনো জৈব পদার্থকে পুরোপুরি জারিত বা অক্সিডাইজড করতে প্রতি লিটার পানিতে ২০০ মিলিগ্রাম অক্সিজেন দ্রবীভূত থাকতে হয়। আর বিওডি হলো কোনো মিশ্রণে ব্যাক্টেরিয়াসহ  বিভিন্ন অনুজীবের অক্সিজেন চাহিদা, যা প্রতি লিটারে ৫০মিলিগ্রাম।  পিএইচ হল মিশ্রনের অম্লতা কতটা তার পরিমাপ, পানির ক্ষেত্রে যা আদর্শভাবে ৬-৯ এর মধ্যে থাকা উচিত।

আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজাজ বলেন, ‘আমরা সাধারণ ধারণা দেশের সবচেয়ে দূষিত নদী হলো বুড়িগঙ্গা। তবে আমরা জরিপে দেখেছি ঢাকা বিভাগেই বুড়িগঙ্গার চেয়েও দূষিত নদী আরও আছে’।

‘আমরা আরও যা দেখেছি ৫৬টি নদীর সবগুলোতেই প্লাস্টিক এবং পলিথিন দূষণ রয়েছে, যা সত্যিই উদ্বেগের,’ বলেন তিনি।

গবেষণার ৫৬টি নদীর ১৯টি ঢাকা বিভাগের যার সবগুলোই মারাত্মক দূষণের শিকার।

এছাড়াও জরিপে খুলনার ৭টি, সিলেটের ৫টি, চট্টগ্রামের ৮টি, রাজশাহীর ২টি, বরিশালের ১১টি ও রংপুরের ৪টি নদীর দূষণমাত্রা দেখা হয়।

মোহাম্মদ আজাজ আরও বলেন, নদীদূষণে স্থানীয় বাসিন্দা বিশেষ করে যাদের এই পানির সঙ্গেই বেঁচে থাকতে হয় তাদের ওপর খুবই বাজে প্রভাব পড়ছে।

সমীক্ষায় ঢাকার বাইরের কয়েকটি নদী যেগুলোর আশেপাশে কোনো বড় কলকারখানা নেই সেখানে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৪ দশমিক ৫ থেকে ৮ মিলিগ্রাম পাওয়া গেছে। তবে পিএইচ লেভেল, সিওডি কিংবা বিওডির মাত্রা অনেক বেশি, বলেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৫৬টি নদীর মধ্যে ২৫টিরই ৫ মিলিগ্রামেরও কম পাওয়া গেছে। যা মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বুড়িগঙ্গা, টঙ্গী খাল, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, গাজীপুরের লবণদহ, নরসিংদীর হাড়িধোয়া, সিলেটের সুতাং এবং বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতিলিটারে ১ মিলিগ্রামেরও কম পাওয়া গেছে, আর ঢাকা বিভাগের বালু ও তুরাগ নদীতে এর পরিমাণ ২ মিলিগ্রামের কম।

সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগের ভোলা খালসহ পাঁচ নদী রামনাবাদ, আন্ধারমানিক, খাপরা ভাঙ্গ ও বলেশ্বর নদী মারাত্নক প্লাস্টিক দূষণের শিকার।

৫৬টি নদীর মধ্যে ১৬টি গৃহবর্জ্য ও প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণের শিকার।

অন্যদিকে ৩৫টি নদী প্লাস্টিক, কলকারখানার বর্জ্য এবং পৌরসভার বর্জ্য ফেলার কারণে দূষিত হয়েছে।

রংপুরের কেবল তিনটি নদী ছাড়া দেশের সব বিভাগের নদীই শিল্পকারখানার দূষণের শিকার।

২০১৬ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল দেশের অন্তত ২৯টি নদী চরম নদীদূষণের শিকার।

রাজধানীর দূষণ নিয়ে কাজ করা বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, নদী দূষণ এখন বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহরেই প্রভাব ফেলছে।

‘শহরের পাশে নদী থাকলে শিল্প-কারখানাগুলো সেখানে বর্জ্য ফেলছে। তা না হলে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নদীগুলোকে দূষিত করছে,’ তিনি বলেন।

তিনি বলেন, নদীদূষণ বন্ধ করা সরকারের জন্য অগ্রাধিকার বলে মনে হয় না। নইলে এজন্য কঠোর আইনের প্রয়োগ হতো।

‘অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা বিবেচনা করেও সরকারকে নদী দূষণ কমাতে হবে, বলে যোগ করেন তিনি।

মূল উৎসঃ নদীদূষণ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র | The Daily Star Bangla

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *